Tuesday, December 22, 2020

ক্যানভাসার।

 ক্যানভাসার!   (প্রবন্ধ)


এম ডি আজাদ। 


তখন আমি জগন্নাথ কলেজে পড়ি! 

ঢাকার সরকারী জগন্নাথ কলেজ, সদর ঘাট, ঢাকায় অবস্থিত।

সদরঘাট নামটা অনেক আগের। 

সদর মানে প্রধান আর ঘাট মানে পাড়, নদীর তীর, তট ইত্যাদি। 

সেই যাই হোক, যা বলছিলাম! 

বুড়িগঙ্গার কাছাকাছি এই সরকারী জগন্নাথ কলেজ! 

আমি মাস্টার্স পরি! জগন্নাথ কলেজে দুটো শিফট! চাকুরী করি বিধায় আমাকে নাইট শিফটে পড়তে হত! 


বাসের নাম মুড়ির টিন! 

গুলিস্তান থেকে সদরঘাট যে বাস যেত, তাতে থাকত না তিল ধারনের জায়গা! লোকাল বাস! গুলিস্তান, নবাবপুর রোড দিয়ে যেত। 

গাদাগাদি লোক, একজনের উপর আর একজন, তিল ধারনের জায়গা নেই, তাই স্থানীয় নাম দেয়া হয়েছে বাসের- মুড়ির টিন। 

গুলিস্তান থেকে সদরঘাট যেতে ২০/২৫ মিনিটের পথ, সেই বাসে যেতে লাগাত প্রায় এক ঘন্টা! 

কারণ ১০/৫০ হাত দুরে দুরেই থামিয়ে দিত! একটা লোক যদি ভুলেও তার হাত উপরের দিকে তুলত, বাস থেমে যেত, তাকে নেয়ার জন্য! 

আমি বাসে বেশি যেদিন ভিড় হতো, কিংবা কোন ক্লাস পরীক্ষা থাকত, সেদিন টেম্পু বা টমটমে করে কলেজে যেতাম! 

একটু ভাড়া বেশি, তাই টমটমে খুব একটা  যাওয়া হত না।

বাসে ছাত্র হিসেবে ৫০ পয়সা আর টমটমে লাগত ৫ টাকা। 

টমটম ব্যক্তি চালিত, তাই কোন হাফ ভাড়া নেই।

সেদিন ক্লাস শেষে বাসে চেপে বসে আছি। আমি বাসের সামনের দিকে বসা! আমার ডানে, বামে মাথার উপর অনেক যাত্রিতে ঠাসা!

হটাৎ শুনি এক ক্যানভাসারের কন্ঠ! 

বিভিন্ন রকম বই তার হাতে! 

এই যেমন সহজে নামাজ শিক্ষা,  কি করিলে কি হয়?

স্বপ্নের অর্থ বা খাবনামা!

কোন পথের দুরত্ব কত? 

আয়তুল কুরসি সহ ছোট ছোট সুরার বই! মরনের আগে পরে,

বিখ্যাত মনীষিদের বানী, পকেট নামাজ শিক্ষা ইত্যাদি! 

সরাসরি ক্যানভাসারের কথাগুলো আজও আমার কানে ভেসে বেড়ায়!

সে একহাতে অনেকগুলো বই চেপে ধরে রেখে আর একহাতে একটি বই উঁচু করে সবাইকে দেখার মতো করে নাড়াচাড়া করে করে বলত, " গাড়ির সব যাত্রির নিরাপদ ভ্রমণ কামনা করছি! 

মুসলমান ভাইদের সালাম, হিন্দু ভাইদের নমস্কার আর অন্যান্য ভাইরা আমার ভক্তি নিবেন!

চলার পথে আল্লাহকে স্মরণ করুন!

হাত সাবধানে রাখুন। মানিব্যাগ হাত দিয়ে চেপে ধরুন! কারণ বাসে অনেক যাত্রির মাঝে কিছু অতিভদ্র আর লাজুক টাইপের যাত্রিও কিন্তু রয়েছে! 

লাজুক এইজন্য বলছি যে, তারা তাদের কাজ আপনার সামনে করবেনা। আপনি একটু বেখেয়ালি হলে বা ঘুম ঘুম ভাব আসলে তখন কাজটি করে বসবে! যাক ভাই অনেক কথা হলো! 

আমার কথা আজ আর বেশি লম্বা করব না!

আমার মনটাও ভালো নয়। আজ দুই তিন ঘন্টায় আমি একটি বইও বেঁচতে পারি নাই!

এই যে দেখুন- আমার হাতে যে বইটা- এটা পড়লে আপনি জানতে পারবেন শরিরের কোন জায়গায় তিল থাকলে, কি হয়!

স্বপ্নে যদি আকাশে উড়তে দেখেন, কি তার মানে? 

মৃত লোক যদি স্বপ্নে আপনাকে ডাকে, তাহলে কি হবে?

পানিতে পস্রাপ করলে কি হয়?

আরও আরও অনেক কিছু আপনি এই বই পড়ে জানতে পারবেন!

আর দাম?

এই বই এর দাম পাঁচ টাকা! 

তবে প্রচারের উদ্দেশ্যে আজ আমি এর দাম পাঁচ টাকা নেব না!

যদি নেন, একদাম দুই টাকা, দুই টাকা, দুই টাকা। 

আছেন কোন ভাই?

বইটি নিবেন?

দুই টাকায় এত ভালো বই আর পাবেন না ভাই!

আরে যদি এই বই ফটোকপিও করেন, তবু্ও এর খরচ পড়বে সাত-আটটাকা! 

আর আমি দিচ্ছি মাত্র দুই টাকায়! 

আছেন কোন ভাই-বোন? 

আওয়াজ দিবেন একটু!" 


লেকচারগুলো  শুনতে আমার বেশ ভালোই লেগেছিল!  কিন্তু তার একটি বইও কেও কিনছে না দেখে আমার খুব খারাপ লাগলো!  কেমন যেন অজানা এক মায়ার টানে আমি মোহিত হয়ে গেলাম!

আমার পকেটে সেদিন অনেক টাকা! কম করে হলেও তিনশ তো হবেই!.

এতো টাকা নিয়ে সাধারণত বাইরে কেও যায়না!

এটা ১৯৯৫ সালের দিকের কথা বলছি! তখন একশ টাকা মানেই অনেক টাকা! 

যাক মায়াবশত আমি ক্যানভাসারকে আমার কাছে ডেকে এনে বলি যে, ভাই আমি তিনটা বই নেব! তবে খাব নামা নয়। নামাজশিক্ষা দিন! আমাকে দেখেই ক্যানভাসারের চোঁখ মুখ কেমন যেন মলিন হয়ে যায়! আমি তাকে চিনে ফেলি!  সেও আমাকে চেনে!

ডিপুটি সেক্রেটারিদের কোয়ার্টার এর পাশেই তার কোয়ার্টার! সে বাবার অফিসেরই পিয়ন!


সংসার চলে না! তাই অফিসের পরে বাসে বাসে ফেরী করে করে বই বিক্রি করে কোন মতে সংসার চালিয়ে নেয়া!

কাজ তো কাজই, চুরি তো আর নয়!

কিন্তু ভদ্রলোক আমায় দেখে লজ্জায় লাল হয়ে যায়! কোন দিন তো এমন হয়নি! তবে আজ কোন কুলক্ষনে পরিচিত জনের সাথে দেখা? 

লজ্জায় যেন তার মাথা হেঁট হয়ে যায়। আমি বললাম- কাকা আমি কাওকে বলে দেব না যে, আপনি বাসে বাসে বই বিক্রি করে বেড়ান!  ভয় কেন পাচ্ছেন?

তা ছাড়া আপনি খারাপ কিছু তো করছেন না!

অনেকেই তো খারাপ পথে জীবিকা নির্বাহ করেন! 

আপনি ভালো কাজ করছেন।

ভালো মানুষ আপনি! 

কেন লজ্জা?

দিন আমাকে, তিনটা সহজে নামাজ শিক্ষার বই দিন!

তারপর সে তার অনেক গুলো বই এর মাঝ থেকে নামাজ শিক্ষার তিনটি বই আমার হাতে দিয়ে বলে যে, বাপ এইগুলো কিন্তু দুই টাকা নয়, ছয়টাকা করে!

আমি বলি ছয় না, যদি দশ টাকাও হতো, তবুও আমি নিতাম। আমার মন চেয়েছে তাকে একটু সাহায্য করতে! 

কিন্তু সে সাহায্য নিবে না! 

আমি তাকে একুশ টাকা দিলে, সে আমাকে তিন টাকা ফেরত দিয়ে দেয়। আমি জোড় করে আবার তার পকেটে তিন টাকা ঢুকিয়ে দিলে সে বলে, তিন টাকা কেন দিচ্ছেন? বই এর দাম তো আঠারো টাকা!

আমি তখন বলি যে, এই তিন টাকা দিয়ে আপনার বাচ্চাদের জন্য কিছু একটা কিনে নিয়েন!

এতো রাতে ক্যানভাস করে বাসায় ফিরবেন, তারা অপেক্ষা য় আছে!

কিছু একটা কিনে তারপর বাসায় যান।

ক্যানভাসার অমনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে! তার চোঁখ গড়িয়ে দুইফোঁটা জল আমার পিঠের উপর পড়ে।

ভাই কাঁদছেন কেন? আমি তাকে জিজ্ঞেস করি!

সে বলে, বাসে কতো যাত্রি ছিলো! আমি এতো সুন্দর করে লেকচার দিলাম, কিন্তু কারও মন গলাতে পারলাম না। 

আজ আমার বাসায় চাল, ডাল কিচ্ছু নেই। ভেবেছিলাম বই বিক্রি করে চাল ডাল কিনে নিয়ে যাব! কিন্তু একটা বইও কেও কিনে নেয়নি! 

আমরা না হয় নাই খেলাম! বাচ্চার মায়ের বুকে দুধ নেই, বাচ্চাকে বাইরের দুধ খাওয়াতে হয়! দুধ কেনারও পয়সা ছিলো না! এক্ষনে আপনি দয়া করে তিনটা বই আমার কিনে নিয়েছেন, আবার তিনটাকা বেশিও দিয়েছেন! এখন আমি সবই কিনে নিতে পারব!

আল্লাহ পাক আপনার জান-মালের হেফাজত করুন! 

আপনার মংগল কামনা করছি। 

অনেক বড়ো মনের মানুষ আপনি! 

কোন দিন আপনার অমংগল হবেনা।

বাস গুলিস্তান চলে আসে। আমি তাড়াতাড়ি নেমে যাই।

No comments:

Post a Comment

Google adsense এর সাহায্যে আর্টিকেল লিখে অর্থ উপার্জন করার পদ্ধতি।

 আপনি যদি ভালো ইংরেজি জানা হয়ে থাকেন, তবে অনলাইনে আর্টিকেল লিখে আয় করা কোন ব্যাপারই নয়। আজকাল অনেকেই অনলাইনে ব্লগ খুলে আর্টিকেল লিখে ভালো আয়...